বিতর নামাযের রাকাত সংখ্যা ও তার পদ্ধতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বিতর নামায মূলতঃ তাহাজ্জুদ নামাযের অংশ। তাই রাত্রের পূরা কিয়ামুল্লায়লকেও বিভিন্ন হাদীছে বিতর বলা হয়েছে।  এই জন্যই পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিতর নামাযের উত্তম সময় হচ্ছে শেষ রাত- যখন তাহাজ্জুদ নামায পড়া হয়। কিন্তু সঙ্গত কারণ থাকলে তা এশার নামাযের সাথে পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে- এই নামাযের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করার জন্য।


বিতর নামাযের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট একটি সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয় এ নামায ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১ ও ১৩ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। 

ক) এক রাকাত বিতর: 

এক রাকাত বিতর পড়ার নিয়ম হল, নিয়ত বেঁধে ছানা, সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পড়ে রুকূ করবে। রুকূ থেকে উঠে দুআ কুনূত পড়বে। তারপর দু’টি সিজদা করে তাশাহুদ, দরূদ ও দুআ পড়ে সালাম ফিরাবে।

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ مَثْنَى مَثْنَى وَيُوتِرُ بِرَكْعَةٍ

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের নফল নামায দু’দু রাকাত করে পড়তেন এবং এক রাকাত বিতর পড়তেন।  

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন


الْوِتْرُ رَكْعَةٌ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ

বিতর হচ্ছে শেষ রাতে এক রাকাত নামায। 

عَنْ أَبِي مِجْلَزٍ قَالَ سَأَلْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ عَنِ الْوِتْرِ فَقَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ رَكْعَةٌ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ وَسَأَلْتُ ابْنَ عُمَرَ فَقَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ رَكْعَةٌ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ

আবু মিজলায হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ)কে বিতর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, বিতর হচ্ছে শেষ রাতে এক রাকাত নামায। তিনি বলেন, ইবনু ওমরকেও এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি। তিনিও বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, বিতর হচ্ছে শেষ রাতে এক রাকাত নামায। 


ইমাম নবুবী বলেন, এসকল হাদীছ থেকে দলীল পাওয়া যায় যে, বিতর নামায এক রাকাত পড়া বিশুদ্ধ এবং তা শেষ রাতে আদায় করা মুস্তাহাব। 

আবু আইয়্যুব আনছারী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছেও এক রাকাতের কথা প্রমাণিত হয়েছে। সেই হাদীছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ... যে এক রাকাত বিতর পড়তে চায় সে এক রাকাত পড়তে পারে। 

সাহাবীদের মধ্যে আবু বকর, ওমর, ওছমান, আলী, সা’দ ইবনে আবী অক্কাস, মুআয বিন জাবাল, উবাই বিন কা’ব, আবু মূসা আশআরী, আবু দারদা, হুযায়ফা, ইবনে মাসঊদ, ইবনে ওমর, ইবনে আব্বাস, আবু হুরায়রা, মুআবিয়া, তামীম দারী, আবু আইয়্যুব আনসারী (রাযিআল্লাহু আনহুম) প্রমুখ এবং তাবেঈদের মধ্যে ইমাম যুহরী, হাসান বাছরী, মুহাম্মাদ বিন সীরীন, সাঈদ বিন যুবাইর (রহঃ) প্রমুখ আর প্রচলিত চার মাযহাবের তিন ইমাম ইমাম 

মালেক, শাফেয়ী, আহমাদ (রহঃ) প্রমুখও এক রাকাত বিতর পড়ার পক্ষপাতি ছিলেন।  

সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর মসজিদে এশা নামায আদায় করতেন, অতঃপর এক রাকাত বিতর পড়তেন, এর বেশী নয়। তাঁকে বলা হত, আবু ইসহাক্ব? আপনি এক রাকাতের বেশী বিতর আদায় করেন না? তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি বিতর না পড়ে নিদ্রা যায় না সে দৃঢ়তা সম্পন্ন লোক। 


শায়খ আলবানী বলেন, হানাফী মাযহাবের কোন কোন আলেম বলেন, তিন রাকাতের নীচে কোন নামায নেই। তথা তিন রাকাত বিতর পড়ার ব্যাপারে এজমা (সকলের ঐক্যমত) হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের এই দাবী দলীল বিহীন। কেননা আমরা দেখেছি 


ছাহাবীদের মধ্যে অনেকেই এক রাকাত বিতর পড়েছেন। 

অতএব যারা বলেন, এক রাকাত কোন নামাযই নেই, তাদের জন্য উল্লেখিত আলোচনায় শিক্ষণীয় বিষয় আছে। কেননা ¯^qs নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক রাকাত বিতর নামায আদায় করতেন। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও অনেকে এক্ষেত্রে তাঁর অনুসরণ করেছেন।

ইমাম শাফেয়ী বলেন, মুসলমানগণ একথার উপর ঐকমত্য হয়েছে যে, কারো নিকট যদি রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাত সুষ্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়, তবে কারো কথা মত উহা পরিত্যাগ করা বৈধ নয়।

মহান আল্লাহ্‌ বলেন, 

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ


যারা তাঁর (রাসূলের) নির্দেশের বিপরীত চলে, তারা সতর্ক হয়ে যাক যে, তারা ফেতনায় পড়ে যাবে অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে স্পর্শ করবে। 


খ) তিন রাকাত বিতরঃ 

এ নামায পড়ার বিশুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে দু’টি।

 

প্রথম পদ্ধতিঃ দু’রাকাত পড়ে সালাম ফেরানো। অতঃপর এক রাকাত পড়া। এ পদ্ধতির দলীল হলো- আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 

أَنَّ رَجُلا سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَلاةِ اللَّيْلِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ عَلَيْهِ السَّلَام صَلاةُ اللَّيْلِ مَثْنَى مَثْنَى فَإِذَا خَشِيَ أَحَدُكُمُ الصُّبْحَ صَلَّى رَكْعَةً وَاحِدَةً تُوتِرُ لَهُ مَا قَدْ صَلَّى 

জনৈক ছাহাবী রাতের নামায সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে জিজ্ঞেস করল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, রাতের নামায দু’দু রাকাত করে, যখন ফজর 


হওয়ার আশংকা করবে তখন এক রাকাত বিতর পড়ে নিবে।  

এ পদ্ধতি অনুযায়ী বিতর মূলত এক রাকাতই। দু’রাকাত পড়ে সালাম ফিরানো অতঃপর এক রাকাত পড়া। যেমন ইবনে ওমর (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করা হল দু’দু রাকাত মানে কি? তিনি বললেন: প্রত্যেক দু’রাকাত পর পর সালাম ফিরাবে।  ইবনে ওমর (রাঃ), ইমাম মালেক, শাফেয়ী, আহমাদ, ইসহাক, প্রমুখ এভাবেই বিতর পড়তেন।  

ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)  থেকে আরো বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বিতর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, দু’রাকাত এবং এক রাকাতের মাঝে সালাম ফিরে পার্থক্য করে নিবে।  

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: 


عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي فِي الْحُجْرَةِ وَأَنَا فِي الْبَيْتِ فَيَفْصِلُ بَيْنَ الشَّفْعِ وَالْوَتْرِ بِتَسْلِيمٍ يُسْمِعُنَاهُ

আমি বাড়ীতে থাকাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কক্ষের মধ্যে নামায পড়তেন। তিনি দু’রাকাত এবং এক রাকাতের মাঝে পৃথক করতেন, এসময় তিনি আমাদেরকে শুনিয়ে জোরে সালাম দিতেন।  


হযরত আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এক রাকাত বিতর পড়তেন। তিনি দু’রাকাত এবং এক রাকাতের মাঝে কথা বলতেন।  

عَنْ نَافِعٍ أَنَّ عَبْدَاللَّهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يُسَلِّمُ بَيْنَ الرَّكْعَةِ وَالرَّكْعَتَيْنِ فِي الْوِتْرِ حَتَّى يَأْمُرَ بِبَعْضِ حَاجَتِهِ


নাফে’ বলেন, আবদুল্লাহ্‌ বিন ওমর (রাঃ) বিতরের দু’রাকাত এবং এক রাকাতের মাঝে সালাম ফিরাতেন এবং কোন দরকারী বিষয় থাকলে তার নির্দেশ দিতেন। 


দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ দু’রাকাত পড়ে তাশাহুদের জন্য না বসে সালাম না ফিরিয়ে একাধারে তিন রাকাত পড়ে সালাম ফেরানো। এ কথার দলীল, হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনি রাকাত বিতর নামায পড়তেন। এর মধ্যে তাশাহুদের জন্যে বসতেন না, একাধারে তিন রাকাত পড়ে শেষ রাকাতে বসতেন ও তাশাহুদ পড়তেন। এভাবেই বিতর পড়তেন আমীরুল মু’মেনীন হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)।  

একাধারে তিন রাকাত বিতর পড়ার ইঙ্গিতে আরেকটি হাদীছ পাওয়া যায়। উবাই বিন কা’ব (রাঃ) বলেন, 

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الْوِتْرِ (بِسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى) وَفِي الرَّكْعَةِ الثَّانِيَةِ (بِقُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ) وَفِي الثَّالِثَةِ (بِقُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) وَلا يُسَلِّمُ إِلاَّ فِي آخِرِهِنَّ

রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিতর নামাযে প্রথম রাকাতে ‘সাব্বেহিসমা রাব্বিকাল আ’লা’, দ্বিতীয় রাকাতে ‘কুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফেরূন’ এবং তৃতীয় রাকাতে ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ পড়তেন। আর সবগুলো রাকাত শেষ করেই সালাম ফেরাতেন। 

Related Posts

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Subscribe Our Newsletter